উর্বরতা হারাচ্ছে পাহাড়
খাগড়াছড়ির শত শত টিলা গিলে খাচ্ছে আফ্রিকান কাসাভা
স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় :
২৯-১২-২০২৪ ০৩:১৭:২৭ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
২৯-১২-২০২৪ ০৬:৫১:৩৯ অপরাহ্ন
ফাইল ফটো
পার্বত্য চট্টগ্রামে দিন দিন সম্প্রসারিত হচ্ছে আফ্রিকার ফল কাসাভা চাষ। অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করায় ধস ও মাটি ক্ষয়ে উর্বরতা হারাচ্ছে শত শত পাহাড়ি টিলা। এছাড়া বন উজাড় করে কাসাভা চাষের কারণে জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়েছে। এদিকে মৃত্তিকা বিজ্ঞানীরাও পাহাড়ে কাসাভা চাষকে জুম চাষের চেয়েও ক্ষতিকর হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ঢাকার দুটি বাণিজ্যিক কোম্পানি সুদমুক্ত ঋণসহ সার্বিক সহায়তার মাধ্যমে প্রায় ৭ হাজার একর পাহাড়ি জমিতে চুক্তিভিত্তিক কাসাভা চাষে উত্সাহ যোগাচ্ছে গরীব লোকজনদের। তারমধ্যে মাটিরাঙ্গায়ই রয়েছে প্রায় ১৩০০ একর। অন্যদিকে, ঐ কোম্পানি দুটিই কেবলমাত্র ক্রেতা হওয়ায় তাদের নির্ধারিত দামেই কাসাভা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে চাষিরা। ফলে তারা ন্যায্য মূল্য থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।
পার্বত্য এলাকায় ঠেংগা আলু নামে অধিক পরিচিত কাসাভা বা শিমুল আলুর চাষাবাদ শুরু হয় ১৫-২০ বছর আগে। প্রথম দিকে সীমিত আকারে চাষ হলেও দিন দিন ব্যাপকহারে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে এ কাসাভার চাষ। খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা, রামগড়, মানিকছড়ি, লক্ষ্মীছড়ি, গুইমারা, দীঘিনালা উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় হাজার হাজার একর পাহাড়ি টিলায় কাসাভার চাষ হচ্ছে। সরকারিভাবে বন্দোবস্তীমূলে পাওয়া ব্যক্তিমালিকাধীন পাহাড়ি টিলার বনজঙ্গল কেটে সাফ করে কাসাভা গাছের কান্ড ছোট ছোট টুকরা করে রোপন করা হয়। এর ৭-৮ মাস পর মাটি খুঁড়ে তোলা হয় আলু। এভাবে মাটি উপড়ে আলু তোলার দরুন বর্ষাকালে বৃষ্টির পানির স্রোতে টিলাগুলোতে মাটি ধসের সৃষ্টি হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২৬ অর্থবছরের মধ্যে খাগড়াছড়িতে কাসাভা চাষ ১৫ হাজার একর পর্যন্ত সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে ঐ কোম্পানির। রাঙামাটি ও বান্দরবানেও কাসাভা চাষ সম্প্রসারণ করা হচ্ছে।
খাগড়াছড়িতে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনকারী বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. জুলফিকার আলী ফিরোজ বলেন, পাহাড়ে যে পদ্ধতিতে কাসাভার চাষ হচ্ছে তা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক। কাসাভার গাছের মূলই আলু হিসাবে ব্যবহার হয়। মাটির অনেক গভীরে থাকা এ মূল তোলার জন্য টিলার মাটি কোদাল দিয়ে উপড়ে ফেলা হয়। এভাবে এলোপাথাড়ি খুঁড়াখুঁড়ির কারণে পুরো টিলার মাটিই আলগা হয়ে পড়ে। বর্ষার সময় অল্প বৃষ্টি হলে সহজেই ধসে পড়ে টিলাগুলোর মাটি। এছাড়া ভূমির উপরিভাগে থাকা মাটির উর্বর উপাদান বা টপ সয়েলও ধসে যায়। ফলে টিলাগুলো হয়ে পড়ে অনুর্বর। তিনি বলেন, এক ইঞ্চি উর্বর মাটি বা টপ সয়েল সৃষ্টি হতে একশ বছরের মত সময় লেগে যায়। অথচ এ মূল্যবান উপাদানই নষ্ট করা হচ্ছে কাসাভা চাষের কারণে।
খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ পরিচালক মো. বাছেরুল আলম বলেন, সমতল ভূমিতে চাষাবাদ করলে ক্ষতি নেই। কিন্তু পাহাড়ি টিলায় কাসাভা চাষ করায় মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। তিনি জানান, কৃষি বিভাগ এ ব্যাপারে চাষিদের সচেতন করতে উদ্যোগ নিয়েছে।
চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উৎপাদিত কাসাভা সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কারখানায় পৌঁছানোর পর মণ প্রতি ৪৬০ টাকা হারে দেওয়া হয় চাষিদের। একটি কোম্পানির কারখানা হবিগঞ্জের অলিপুর এবং অপরটির কারখানা নারায়ণগঞ্জ অবস্থিত। নূরুল আফসার নামে এক চাষি জানান, এক গাড়িতে ১২ মেট্রিক টন কাসাভা হবিগঞ্জে কোম্পানির কারখানায় পৌঁছানোর পর ৪-৫ হাজার টাকাও লাভ হয়না। চাষাবাদ, কেরিং এবং সড়কের লাইন খরচ বাদ দিলে পকেটের লাভের অংশ থাকে অতি নগণ্য। তবুও পেটের ভাত যোগাড় করতে এ আলুর চাষ করা। জানাযায়, চাষাবাদের খরচ হিসাবে কোম্পানি বিনা সুদে চাহিদামত অগ্রিম ঋণ সুবিধা দেয়ার কারণে দরিদ্র লোকজন কাসাভা চাষে উত্সাহিত হয়।
খাগড়াছড়ি বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ও জেলা পরিবেশ ও বন উন্নয়ন কমিটির সদস্য সচিব মো. ফরিদ মিয়া বলেন, খাগড়াছড়িতে সরকারের বন্দোবস্ত দেওয়া পাহাড়ি টিলাগুলোতেই কাসাভা চাষ হচ্ছে। ফলে বনবিভাগের কিছু করার এখতিয়ার নেই। তিনি বলেন, বন-জঙ্গল কেটে আগুনে পোড়ানোর পর পাহাড়গুলোতে কাসাভা চাষ করা হচ্ছে। এতে শত শত পাহাড়ের বন ধ্বংসের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যও বিপন্ন হচ্ছে। এক কথায় পাহাড়ে কাসাভা চাষের কারণে এ পার্বত্য এলাকার প্রকৃতি ও পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিভাগের সমন্বিত উদ্যোগ ব্যতীত পাহাড়ে কাসাভা চাষ বন্ধ করা সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়েও তিনি চিঠি লিখেছেন বলে জানান।
মাটিরাঙ্গার পিটাছড়া বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ উদ্যোগ নামে একটি সংগঠনের প্রধান মাফুজ আহমেদ রাসেল বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে কাসাভা চাষের দ্রুত বিস্তার উদ্বেগজনক। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এখানকার বনাঞ্চল পুরোপুরি বিলীন হয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, ক্ষতিকর কাসাভা চাষাবাদ বন্ধ করার দাবিতে বেলা ও তাদের সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে চট্টগ্রামে মানববন্ধন কর্মসূচিও পালন করা হয়। খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন বিভাগর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ-আবেদন পেশ করা হয়েছে। কিন্তু এর কোন ফল পাওয়া যায়নি।
বাংলা স্কুপ/ প্রতিনিধি/ এনআইএন/এসকে
প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স